আজ খবর (বাংলা), কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ০৫/০৯/২০২০ : এই বছর পশ্চিমবঙ্গ থেকে দু'জন শিক্ষক ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের তরফ থেকে দেওয়া শিক্ষকদের জাতীয় পুরস্কার। তাদের মধ্যে একজন হলেন আলিপুরদুয়ার টোটোপাড়ার ধনপতি টোটো মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শ্রীমতি মিশা ঘোষাল, যার জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য হল আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাট ব্লকের বিশ্বের ক্ষুদ্রতম জনজাতি টোটো উপজাতিদের জন্য স্থাপিত বিদ্যালয়ের উন্নতির সাধন। অপর পুরস্কৃত ব্যক্তি হলেন, পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুরের নেপালি পাড়া হিন্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ডাঃ কলিমুল হক, যিনি এক অনন্য সাফল্য অর্জন করে দুর্গাপুরের একটি সাধারণ অচেনা উচ্চ বিদ্যালয়কে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছেন।
আদতে শিলিগুড়ির বাসিন্দা শ্রীমতি মিশা ঘোষাল ২০০৮ সালের ২৫ শে সেপ্টেম্বর, মালদার সুজাপুর গার্লস হাই স্কুল থেকে এসে এই বিদ্যালয়ের হাল ধরেন। এই প্রত্যন্ত উপজাতি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে প্রায় ১২বছর পার করার পরে, তিনি এখন তার কাজ কর্ম নিয়ে গর্ব করতেই পারেন, কারণ তার এই কঠোর পরিশ্রমকে কেন্দ্রীয় সরকার ও স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০৮ সালে যখন শ্রীমতি ঘোষাল স্কুলে যোগ দেন তখন মাত্র এক জন ছাত্র মধ্যমিকে পাস করতে পেরেছিল। সেই জায়গায় এই বছর, বিদ্যালয়ের সাফল্যের হার ৮০%এরও বেশি। তিনি প্রায় এককভাবে বিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবর্তন এনেছেন। "এই পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হবার পরে একজন শিক্ষক হিসাবে আমার দায়িত্ব কয়েক গুণ বেড়ে গেল," বলেন প্রধান শিক্ষিকা। “যখন আমি জানতে পারলাম যে এই অত্যন্ত সম্মানীয় পুরষ্কারের জন্য আমাকে মনোনীত করা হয়েছে তখন একটি রোমাঞ্চকর অনুভূতি আমাকে গ্রাস করেছিল। আমার পরিবারের সদস্য, সহ শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব এবং অন্যান্য প্রচুর লোক আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সেই সময় মনে পড়ছিল আমার সেদিনের কথা যেদিন আমি বিদ্যালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করি। ভাগীরথ টোটো, যিনি তৎকালীন স্কুল সচিব ছিলেন, আমাকে করজোড়ে বলেছিলেন যে ম্যাডাম আপনি দয়া করে আমাদের ছেড়ে যাবেন না, এখানে কেউই এসে বেশিদিন থাকতে চান না, ফলে বাচ্চাদের পড়াশোনাও ঠিক ঠাক হয়না। সেদিন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে একজন শিক্ষক হিসাবে আমার একমাত্র লক্ষ্য হবে এই উপজাতি সম্প্রদায়ের শিশুদের সেবা করা এবং তাদের সাথে সময় কাটানো”, মিশা ঘোষাল জানান প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোকে।
প্রতিদিন তাকে তার মাদারিহাট-টোটোপাড়া রোডের বসত বাড়ী থেকে স্কুলে পৌঁছাতে প্রায় ২২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। তিনটি নদী তিতি, বাঙরি ও হাওরি এবং অসংখ্য ছোট-বড় ঝোড়া উপ-ঝোড়া এবং ঘন বন অতিক্রম করে এই দুরূহ স্থানের স্কুলে পৌঁছতে প্রায় দেড় ঘন্টা সময় লাগে । বর্ষার সময়এই অঞ্চলটি বন্যার ফলে প্রায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপের আকার নেয়ে কিন্তু এই সময় ও স্কুল যাতে কোনভাবেই কামাই না হয় তার জন্য তিনি টোটোপাড়ায় একটি বাড়িও ভাড়া নিয়েছেন।"স্কুলে আসার সময় বেশ কয়েকবার আমি রাস্তায় হাতির পাল এবং বাইসনের মুখোমুখি হয়েছি তা সত্ত্বেও আমি এই গ্রামবাসীদের শিক্ষা দানের জে ব্রত আমি নিয়েছি তা থেকে আমাকে বিরত করতে পারে নি", মিশা দাবীর কথায় আত্মবিশ্বাসের সুর।
তিনি ই-ক্লাস, স্মার্ট ক্লাস রুম এবং আনন্দময় শিক্ষার উপর জোড় দিয়েছেন। তার অভিনব সংগীত থেরাপির প্রয়োগ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পেয়েছে। শুধু তাই নয়, তিনি শিক্ষার্থীদের সার্বিকউন্নয়নের জন্য সংগীত, অঙ্কন, গান-বাজনা ইত্যাদির উপরও জোর দিয়েছেন এবং একটি বিষয় সুনিশ্চিত করেছেন যে কোন ক্লাস যেন ফাঁকা না যায়। প্রধান শিক্ষিকা নিজে যদিও টোটো সম্প্রদায়ের নন তাও তিনি টোটো সংস্কৃতি, তাদের অভ্যাস, পছন্দ, তাদের সংগীত, লোক সংস্কৃতি, তাদের নৃত্য, খাদ্যাভাস এবং অন্যান্য জিনিসগুলি আওত্বে এনেছেন যাতে তাদের সাথে তিনি মিশতে পারেন, তাদের বুঝতে পারেন। স্কুলটিতে এ বছর থেকে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি শুরু করেছে। টোটো জনজাতি নিয়ে গবেষণা রত গণিতের এই শিক্ষিকার এখন একটাই লক্ষ্য এমন একটি বিদ্যালয় গড়ে তোলা যা সকলের কাছে প্রশংসার বিষয় হয়ে উঠবে।
অপর পুরস্কার প্রাপ্ত শিক্ষক হলেন পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুরের নেপালিপাড়া হিন্দি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ডাঃ কালিমুল হক। প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর সাথে কথা বলার সময় ডঃ হক জানান যে এই জাতীয় স্বীকৃতি তাকে তার কাজ আরও ভালোভাবে করতে অনুপ্রেরনা জোগাবে। বিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থীদের মঙ্গলের লক্ষ্যে তার কাজ আরও বেড়ে গেল। প্রকৃতপক্ষে তিনি কেবলমাত্র বিদ্যালয়ের পরিকাঠামোই নয়, স্কুলের ভাবমূর্তিরও সার্বিক পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। “২০১০ সালে যখন আমি এই স্কুলে যোগদান করি তখন পরিকাঠামোগত অবস্থা খুব খারাপ ছিল, মাত্র দশটি শ্রেণিকক্ষ এবং ১৯ জন শিক্ষক ছিলেন। এখন সেখানে ৫৭ টি শ্রেণী কক্ষ এবং ৩৪ জন শিক্ষক রয়েছেন, শুধু তাই ই নয় এখন স্কুলে ৪০ টি কম্পিউটার সমেত একটি কম্পিউটার ল্যাব রয়েছে, ৫ টি স্মার্ট ক্লাস রুম, সুসজ্জিত লাইব্রেরি সহ একটি প্রমান সাইজের পড়ার ঘর, সেন্ট্রালাইজড অডিও সিস্টেম, একটি কিচেন গার্ডেন, একটি ভার্মিকম্পোস্টিং সেট-আপ, কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থা, একটি বড় অডিটোরিয়াম এবং একটি আর্ট গ্যালারী এবং পাইলট প্রকল্প হিসাবে হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতি ব্যবহার করে চাষাবাদও করা হচ্ছে” জানালেন ডঃ হক। তবে প্রধান শিক্ষক তার স্বীকৃতির কৃতিত্ব কেবল নিজেই নিতে চান না বরং এটি তার শিক্ষকদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চান। "আজ যা অর্জন করা গেছে তা আমার সহকর্মী শিক্ষক এবং বিদ্যালয়ের সাথে সংযুক্ত অন্যদের সক্রিয় এবং সমবেত প্রচেষ্টা ছাড়া সম্ভব হত না", বিনয়ের সাথে জানালেন ডঃ হক। আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এডিডিএ), ডিএসপি, সেল এর সাহায্য ছাড়াও স্থানীয় জনগণ, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলি এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষ স্কুলটির উন্নয়নের জন্য নগদে বা অন্য কোনও ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখন বিদ্যালয়ের গ্রহণযোগ্যতাও এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, যখন ডঃ হক ২০১০ সালে এই বিদ্যালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন, তখন ২০৯৯ জন শিক্ষার্থী ছিল, এখন এই সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬২৫এ। আগে এই স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা অন্যের কাছে বিদ্রূপের পাত্র হয়ে উঠত, এখন শিক্ষার্থীরা গর্বের সাথে বলে যে তারা কোন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এবং তাদের এই গর্বই ডঃ কলিমুল হকের সাফল্যের হাতিয়ার।
১৯৫৮ সাল থেকে শিক্ষকদের জাতীয় পুরস্কার প্রদানের রীতি শুরু হয় । এই পুরস্কার দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল দেশের সেরা কয়েকজন শিক্ষকের অনন্য অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাদের সম্মান জানানো, যারা তাদের দায়িত্ব এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে কেবল স্কুল শিক্ষার মান উন্নত করেনি, তাদের ছাত্রদের জীবনকেও সমৃদ্ধ করেছেন। ২০২০ সালের পুরস্কার প্রাপকদের নাম বাছাই করার লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রনালয় জাতীয় পর্যায়ে একটি স্বতন্ত্র জুরি গঠন করেন। জাতীয় স্তরের স্বতন্ত্র জুরি ৩৬ টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দ্বারা প্রেরিত ১৫৩ জন শিক্ষকের কাজ পর্যালোচনা করেন। জুরি সমস্ত সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত শিক্ষকদের আবেদন ও উপস্থাপনা বিবেচনা করে এবং বিশদ আলোচনা শেষে ২০২০ সালে জাতীয় পুরষ্কারের জন্য ৪৭ জন প্রার্থীর নাম সুপারিশ করেছিল।