আজ খবর (বাংলা), নতুন দিল্লী, ১১/০৩/২০২০ : আজ সংসদে সারাদিন ধরে আলোচনা চলল দিল্লীর হিংসা নিয়ে। সারাদিন ধরে বিভিন্ন দলের সাংসদরা নানান প্রশ্ন তুললেন, কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী থেকে তৃণমূলের সৌগত রায়, প্রত্যেকেরই অভিযোগের আঙ্গুল ছিল কেন্দ্র সরকারের দিকে। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে গিয়ে AIMIM নেতা ওয়েইসির লক্ষ ছিল নরেন্দ্র মোদির দিকে। তিনি আজ সংসদে বলেন, "দিল্লীর ঘটনাকে দাঙ্গা বলা ঠিক নয়, এটা হল বিশেষ একটি কট্টরবাদী সম্প্রদায়ের হিংসা। কট্টর হিন্দুরাই দাঙ্গা করেছে, আমাদের লাশের ওপর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। দিল্লীর দাঙ্গায় মুসলমানরাই মারা গিয়েছে।"
সবার শেষে নিজের বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, "আজ সকাল থেকেই সদনে দিল্লীর হিংসা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। দিল্লীর এই হিংসা যাঁদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, তাঁদের প্রতি আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি, সেইসঙ্গে তাঁদের আত্মীয় পরিজনদের প্রতি নিজের সমবেদনা ব্যক্ত করছি। তবে যেভাবে গোটা দেশ ও দুনিয়ার সামনে দিল্লীর হিংসার রঙ্গিন ছবি তুলে ধরা হয়েছে সেটা ঠিক নয়।"
অমিত শাহ বলেন, "অধীর চৌধুরীর কথাতেই প্রথমে আসছি, তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন দিল্লীর হিংসা নিয়ে আলোচনা করতে এত দেরি হল কেন ? আমি বলতে চাই, আমি আগেই জানিয়েছিলাম এই বিষয়ে হোলির পর কথা বলব, তাই আজ বলছি। কেন হোলির পর সেটা নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন ! কারণ, দিল্লীতে যা কিছু ঘটেছে তার মুলে যেতে হলে পুলিশের কিছুটা সময় দরকার ছিল। সেই সময়টুকুই যা নিয়েছি, আজ আমি সকলের সামনে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছি, কিন্তু এই আলোচনা করতে গিয়ে যে সব তথ্যগুলো আমার দরকার ছিল সেগুলো সংগ্রহ করতে কিছুটা সময় তো আমার লাগবেই !"
এই সময় অধীর চৌধুরী মন্তব্য করেন, "দাঙ্গার সাথে হোলির কি সম্পর্ক ?" তার উত্তরে অমিত শাহ বলেন, "হোলির সাথে দাঙ্গার কোনো সম্পর্ক নেই, বরং আপনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন দিল্লীর অশান্তির সময় পুলিশ কি করছিল ? আমি সেটার উত্তর দিই। প্রথমেই বলি, পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা সদনের ভিতরে বা বাইরে করার অধিকার আপনাদের অবশ্যই আছে, কিন্তু যখন হিংসার আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পুলিশ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে, সেই সময় পুলিশের সমালোচনা করলে তাদের মনোবল কমে যেতে পাপারত , সেটা কিন্তু বিরোধীদের খেয়াল রাখা উচিত ছিল, যা রাখা হয় নি। উত্তর পূর্ব দিল্লীতে দুই সম্প্রদায়ের ২০ লক্ষ মানুষ একত্রে থাকেন। তার ভৌগলিক অবস্থানটাও মাথায় রাখতে হবে, জায়গাটি উত্তর প্রদেশ রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত। ওই জায়গায় পুলিশের চার চাকার গাড়িও সব জায়গায় ঢোকেনা। তবু মাত্র ৩৬ ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ দাঙ্গাকে আর বাড়তে দেয়নি, দিল্লীর অন্যত্র ছড়িয়ে পড়তে দেয় নি । আমি বলব সেটা পুলিশশের সাফল্য। যাতে দিল্লীর অন্যত্র দাঙ্গা ছড়িয়ে না পরে পুলিশ আগে সেই ব্যবস্থা নিয়েছিল । ২৫ তারিখ রাত্রি ১১টার পর আর কোথাও কোনো হিংসার ঘটনা ঘটেনি।"
অমিত শাহ বলেন, "সৌগত রায় এবং অন্যেরা প্রশ্ন তুলেছিলেন আমার ভূমিকা নিয়ে, যে আমি সেই সময় ট্রাম্পের সাথে ছিলাম। কিন্তু আমি আপনাদের বলছি, আমি ট্রাম্পের সাথে ছিলাম আগের দিন, যেহেতু জায়গাটা আমার সাংসদ এলাকায় পরে। পরের দিন আমি তাঁর সাথে ছিলাম না, লাঞ্চেও ছিলাম না, তাজমহলেও ছিলাম না, আমি পুরো সময় পুলিশের সাথে বৈঠক করেছি। যে মুহূর্তে দিল্লীর অশান্তির খবর আমি পেয়েছি, সেই মুহূর্ত থেকে আমি পুলিশের সাথে বৈঠক করতে শুরু করে দিয়েছিলাম, যদি প্রমাণ চান, তাহলে রেজিস্টার দেখে নিন।"
অমিত শাহ আজ বলেন, "আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, সেই সময় কেন সেনা নামানো হয় নি ? আমি বলি, দিল্লীতে হিংসার সময় ১৩ কোম্পানি সিআরপিএফ সহ মোট ৩০ কোম্পানি বাহিনী কাজ করেছে। এখনো স্পর্শ কাতর এলাকায় ৮০ কোম্পানি বাহিনী ও পুলিশ মজুত রয়েছে। ২৫ তারিখ রাত্রি থেকেই গোটা ঘটনার পর আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। ২৭ তারিখ থেকে আজ পর্যন্ত মোট ৭০০টি FIR দায়ের হয়েছে, আর দুই সম্প্রদায় মিলিয়ে মোট ২৬৪৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা সকলের কাছে আবেদন করেছিলাম, যে কোনো মানুষের কাছে যদি দিল্লীর হিংসার কোনো ফুটেজ থেকে থাকে, তাহলে What's App এর মাধ্যমে তা আমাদের কাছে পাঠানোর জন্যে। আপনারা খুশি হবেন, এখনও পর্যন্ত হাজারেরও বেশি ফুটেজ আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। অঙ্কিত শর্মার হত্যার ভিডিও খুব সম্ভবত তার মধ্যেই আছে। ভিডিও ক্যামেরা রঙ দেখে না, ধৰ্ম দেখে না। উপযুক্ত সফটওয়ারের মাধ্যমে আমরা প্রত্যেকের ফেস প্রুফ তৈরী করছি। এই তালিকায় আছে ১১০০ লোক। উত্তর প্রদেশের সীমানা দিয়ে ৩০০ লোক দিল্লীতে ঢুকে এসে দাঙ্গায় অংশ নিয়েছিল, আমরা তাদেরকেও চিহ্নিত করার কাজ করছি। এ ব্যাপারে মোট ৪০টি টিম তৈরী করা হয়েছে। ২টি বিশেস তদন্তকারী দল (SIT) তৈরী করা হয়েছে, অত্যন্ত অভিজ্ঞ ও সুদক্ষ অফিসারদের নিয়ে। প্রত্যেকের বয়ান রেকর্ড করা হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত ৪৯টি আগ্নেয়াস্ত্রজনিত কেস দায়ের করা হয়েছে। বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করাও হয়েছে।বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি যেমন চলছে, তেমন বিভিন্ন এলাকায় শান্তি বৈঠকের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আপনাদের আশ্বস্ত করছি, যেমন কোনো নির্দোষ শাস্তি পাবে না, ঠিক তেমন কোনো অপরাধীই ছাড়া পাবে না. মোদী কাউকে ছাড়বে না। দিল্লীর হিংসায় আই এস জঙ্গি সংগঠনের যোগ পাওয়া গিয়েছে, তার জন্যে আরও জেরা করা হচ্ছে।" (এই সব কথার মাঝেই কংগ্রেস সমর্থকেরা অধিবেশন বয়কট করে সদন থেকে বেরিয়ে যান।)
নিজের বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে অমিত শাহ বলেন, "দিল্লীর হিংসায় প্রচুর টাকা এসেছে বাইরে থেকে, যারা এই টাকা বন্টনের কাজ করছিল তাদের মধ্যে ২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ১ জনকে আটক করা হয়েছে। মনে রাখবেন, যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ ছাড়া আমরা কাউকে গ্রেপ্তার করছি না। প্রথমে জুনিয়ার অফিসার, তারপরে ফের একবার সিনিয়ার অফিসার তদন্ত করে দেখে নিশ্চিত হলে, তবেই তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।"
এরপর অমিত শাহ ক্ষয়ক্ষতির একটি খতিয়ান তুলে ধরে বলেন, "দিল্লীর হিংসায় মোট ৫২ জন মানুষের প্রাণ গিয়েছে, ৫২০ জন আহত হয়েছেন। ৩৭১টি দোকান ও ১৪১টি ঘর পুড়েছে। মসজিদ ও মন্দির দুই জ্বলেছে। দুই সম্প্রদায়েরই ক্ষতি হয়েছে, আমরা হিন্দু মুসলমান বলে আলাদা করে দেখি না। তবে এটা বলতে পারি এর আগে ভারতে যত দাঙ্গা হয়েছে, তার ৭৬% হয়েছে কংগ্রেসের আমলেই। যখন শিখেদের কেটে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার কোনো তদন্ত কি আজ পর্যন্ত কংগ্রেস করেছে ? যতদিন না মোদী সরকার এসেছে, ততদিন আপনারা যা খুশি তাই করেছেন। কিন্তু আর নয়। আর সেসব চলবে না।দিল্লীর দাঙ্গা পূর্ব পরিকল্পিত এবং তা ঠান্ডা মাথায় তা পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে আমি মনে করি, তার বেশ কিছু তথ্য প্রমাণ পুলিশের কাছে রয়েছে। বাকি তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। আবার বলছি দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কাউকে ছাড়া হবে না।"
আজকের অধিবেশনে সিটিজেনস এমেন্ডমেন্ট আইন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল, তার জবাবে অমিত শাহ আজ বলেন, "আমরা চুপি চুপি এই আইন পাশ করিয়ে নিই নি, সকলের সম্মতিতে, সংসদের সমস্ত নিয়ম কানুন মেনে, সংবিধান মেনেই তৈরী করেছি এই আইন। কিন্তু বিরোধীরা শুধুমাত্র ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে এর বিরোধিতা করছে এবং উস্কানি দিচ্ছে, বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। বিরোধীরা আগুন নিয়ে খেলছে। আমাদের দেশে অনেক আইন আছে যেগুলি ধর্মের ভিত্তিতেই তৈরী করা হয়েছিল, আমি নিজেই অন্তত সেরকম ২৫টি আইনের কথা জানি। দেশ জুড়ে এই আইনের বিরুদ্ধে যতগুলো মিছিল হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি মিছিল হয়েছে এই আইনের সমর্থনে।"
উস্কানিমূলক বক্তব্যের বিষয়ে বলতে গিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, "রামলীলা ময়দানে মাইকে ঘোষণা করা হয়েছিল 'তোমরা ঘর থেকে বের হও, লড়াই কারো, না হলে তোমাদের ভীতু বলা হবে, এটা আমাদের অস্তিত্বের লড়াই' এগুলো হেট্ স্পিচ নয় ! ১৭ই ফেব্রুয়ারি বলা হল, 'ট্রাম্প ভারতে এলে আমরা সমবেত হয়ে তাঁকে জানাবো এখানে সরকার কি চালাচ্ছে', সেটা হেট্ স্পিচ নয় ! পাঠান নামে একজন বলল, আমরা ১৫ কোটি ১০০ কোটিকে সাফ করে দেব,' সেটা হেট্ স্পিচ নয়! ১৯শে ফেব্রুয়ারি এমন একটা ভাষণ হয়েছিল, যা আমি এখানে বলব না, তবে পুলিশের কাছে পুরো রিপোর্ট আছে, তার পরেই দিল্লীতে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। সেগুলো উস্কানিমূলক ছিল না? আমি ফের একবার জানাচ্ছি, সিটিজেনন্স এমেন্ডমেন্ট আইন কারোর নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেওয়ার আইন নয়, এই আইন নাগরিকত্ব প্রদানের আইন, কেউ যেন এই আইন নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি না করেন। আরও একটা কথা বলতে চাই, দিল্লীর হিংসায় যে সব মানুষের সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেগুলির আমরা ভিডিওগ্রাফি করে রাখছি। আমরা ইতিমধ্যেই দিল্লী হাইকোর্টের কাছে আবেদন জানিয়েছি, যাতে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতিপূরণ আমরা করতে পারি।"
আজকের মত অধিবেশন শেষ হয়ে গেলেও স্পিকার ওম বিড়লা জানিয়ে দেন, আগামীকাল ফের সংসদ সদনে অধিবেশন শুরু করা হবে।
Loading...